বিচারপতি মুফতি তাকি উসমানি একজন প্রখ্যাত আলেম ও লেখক। তার জন্ম পাকিস্তানে, তবে নিজেকে তিনি পুরো উপমহাদেশের আলেম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি হাদীস, ইসলামী ফিকহ, তাসাউফ ও অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞ। আন্তর্জাতিকভাবে যে ক’জন ইসলামী অর্থনীতি নিয়ে কাজ করছেন, তাদের ভেতর তিনি অন্যতম। ১৯৮০-৮২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শরীয়াহ আদালতের এবং ১৯৮২-২০০২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টে শরীয়াহ আপিল বেঞ্চের বিচারক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি।

মুফতি তাকি উসমানি শুধু আলেম হিসেবেই নয়, সাধারণ মানুষের কাছে লেখক হিসেবেও তুমুল  জনপ্রিয়। সেই ধারায় তার প্রায় সব বই বাংলাতেও অনূদিত হয়েছে। তবে বাংলা ভাষাভাষী তরুণ প্রজন্মের কাছে তার ভ্রমণ কাহিনীগুলোই বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তার লেখা ভ্রমণ কাহিনীগুলোর বিশেষত্ব হচ্ছে ভ্রমণের সৌন্দর্যের সাথে সাথে ইতিহাসও উঠে আসে, যা পড়ার মনোযোগ বাড়িয়ে দিতে সাহায্য করে। তেমনই একটি বই ‘স্পেনের কান্না’। স্পেনের সাথে জড়িয়ে থাকা ইসলামিক ইতিহাস যেমন এই বইয়ে ফুটে উঠেছে, তেমনই আলো ছড়িয়েছে বর্তমান স্পেনের নান্দনিক সৌন্দর্য!

 

বইটি মোট ৯টি অধ্যায়ে বিভক্ত, প্রতিটি অধ্যায়ই অত্যান্ত সুন্দরভাবে গোছানো। যদিও কিছুটা ছোট পরিসরে লেখা হয়েছে, তবু একেকটি শহরের বর্ণনায় যেন সেই শহরটি আর তার ইতিহাস চোখের সামনে চলে আসে। আমরাও তাই প্রতিটি শহরের অধ্যায় ধরে ধরে এগোবো যেন প্রতিটি অধ্যায় আর শহরগুলোর নান্দনিকতা আমাদের চোখের সামনেও ফুটে উঠে।

লোজা-তে

বইটি শুরু হয় লোজা (LOZA)  ভ্রমণ দিয়ে। ছিমছাম এই সুন্দর শহরের অনেক কথাই উঠে এসেছে এই অধ্যায়ে। সেই সাথে গ্রানাডা শহর নিয়েও আছে বিস্তর আলোচনা। সর্বপ্রথম আমরা জানতে পারি একসময় এই শহরেরই বাসিন্দা ছিলেন স্পেনের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক, মন্ত্রী ও সাহিত্যিক লিসানুদ্দীন ইবনুল খতিব (মৃত ৭৭৬ হিজরি)। তিনিই সংকলন করেছিলেন স্পেন নিয়ে এক নির্ভরযোগ্য ইতিহাসগ্রন্থ ‘আল-ইহাতা ফি আখবারি গারনাতা’।

ক্যাস্টলের ক্যাথলিক রাজা ৫ম ফার্ডিন্যান্ড ১৪৮২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম এই শহরে আক্রমণ করেন। কিন্তু পরাজয় বরণ করে বিতাড়িত হতে বাধ্য হন। তারপর আবার আক্রমণ করেন এবং লোজার স্থানীয় কিছু গুপ্তচরের সাহায্যে জয়ী হন। মুসলিমদের হাত থেকে প্রথম স্পেনের যে শহরটি ছুটে যায় এটি সেই শহর।বলা হয়ে থাকে, এই ছুটে যাওয়া ছিল এমনই যে ধীরে ধীরে এই জায়গার সব স্থানের নামও পরিবর্তিত হয়ে যায়।

যেমন বলা যাক, ALPAZORA ROAD এর কথা। আরবী উচ্চারণে নামটি একসময় ছিল ‘আল ফাজরা’।গ্রানাডার বর্তমান নামসমূহের যেটাতেই ‘আল’ আছে একটু চিন্তা করলেই আসলে বোঝা যাবে সেসব নাম একসময় আরবী নাম ছিল।

এই অধ্যায় জুড়ে পুরো গ্রানাডা শহরের সৌন্দর্য আর ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে। এখানকার একটি পাহাড়ী নদী জেনিল (XENIL)। এ নদীটি সম্পর্কে লিসানুদ্দীন ইবনুল খতিবের একটি পঙক্তি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল,

মিশর এক নীল নদ নিয়েই এত গর্বিত! অথচ গ্রানাডার এক জেনিলেই রয়েছে হাজার নীল

পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, মনোরম উদ্যান, সবুজ শ্যামল শস্যক্ষেত্রে ঘেরা এই শহরের অপরূপ সৌন্দর্যে  লেখক মুগ্ধ হন, আর সেসব মুগ্ধতাই উঠে এসেছে প্রতিটি বাক্যে। সেই সাথে বর্ণনা করেছেন সেই কালো ইতিহাসও, যখন গ্রানাডার মুসলিম শাসক নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে রাজা ফার্ডিন্যান্ড এবং তার স্ত্রী ইসাবেলার কাছে এই শহরের চাবি হস্তান্তর করেন।

আল-হামরা 

গ্রানাডায় অবস্থিত আল হামব্রা (AL HAMBRA), মুসলিম শাসনামলে নাম ছিল ‘আল-হামরা’, যা একসময় ছিল গ্রানাডার রাজপ্রাসাদ ও দুর্গের জন্য সুপরিচিত। এখান থেকে একটু এগিয়ে গেলেই একটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যার নাম আল মাদ্রাজা। সেসময় এটি ছিল একটি স্বনামধন্য মাদ্রাসা- আল মাদরাসা। ইংরেজি বানানের দিকে খেয়াল করলেই এর বাস্তবতা বোঝা যায়।

Image Source: Nature Research Microbiology Community

 

আল হামরার সৌন্দর্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। এই প্রাসাদেই আছে বিখ্যাত ‘Two Sister hall’, যা সম্পূর্ণ একই রকমের দুটি মর্মর পাথর দিয়ে তৈরি। গ্রানাডার সর্বশেষ শাসক আবু আব্দুল্লাহর মা এখানেই থাকতেন। আল-হামরার জানা অজানা সব ইতিহাস উঠে এসেছে এই অধ্যায়ে। এত বিস্তারিতভাবে লেখক এসব লিখেছেন যে আমাদের চোখের সামনেই  আল-হামরা তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে যাবে!

কর্ডোভা

স্পেনের প্রাচীন নগরীসমূহের একটি কর্ডোভা। এই শহরেই একসময় স্থাপিত হয়েছিল উমাইয়া সালতানাত। সার্জারি বিজ্ঞানের সর্বজনস্বীকৃত বিজ্ঞানী আবুল কাসেম যাহরাবি এই শহরেরই বাসিন্দা ছিলেন। একসময় এই কর্ডোভার গ্রন্থাগার ছিল বিশ্বব্যাপী পরিচিত। বলা হয়ে থাকে, সেসময় এই শহরে এমন কোনো বাড়ি ছিল না যেখানে ব্যক্তিগত লাইব্রেরির দেখা মিলতো না। বাসায় বইয়ের সংগ্রহ থাকাটা বেশ সম্মানজনক হিসেবেই দেখা হতো। কর্ডোভার নান্দনিক সব ভবন আর সুন্দর পরিপাটি রাস্তাঘাট সত্যিই যে কারো মনে জায়গা করে নেবে! এই অধ্যায় জুড়ে এই শহরের অলিগলির সৌন্দর্যের কথাও বলা হয়েছে। সেই সাথে ইতিহাস মিশে আছে পাতায় পাতায়।

Image Courtesy: Getty Images 

 

কর্ডোভার জামে মসজিদ

কর্ডোভার জামে মসজিদ অবশ্য বর্তমানে আর আগের মতো নেই। এখন নানারকম সংস্করণ করে গির্জা হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই অধ্যায় জুড়ে জামে মসজিদের পুরো ভবনের বিশদ বিবরণের সাথে দেখা মিলবে এর ঐতিহাসিক উপাখ্যানের। সেই সাথে দেখা মিলবে মসজিদ থেকে গির্জা হওয়ার ইতিহাসের সাথেও।

ওয়ালিদ কাবির ও তার সেতু

মুসলিম শাসনামলে যে নদী বিখ্যাত ছিল ওয়ালিদ কাবির নামে, সেই নদীরই বর্তমান নাম ‘Guidal Quivir’। বর্তমান ইউরোপের সুন্দর নদীগুলোর একটি।

Image source: Britannica.com

 

এই নদীর উপরই নির্মিত হয়েছিল বিখ্যাত সেতু, যা বর্তমানে রোমান ব্রিজ অব কর্ডোভা নামে পরিচিত।এই সেতুটিই মুসলিম শাসনামলে ‘ওয়ালিদ কাবির সেতু’ নামে বিখ্যাত ছিল।

 

মদিনাতুয যাহরা

কর্ডোভা থেকে মাত্র আট মাইল দূরত্বে অবস্থিত মদিনাতুয যাহরা। একসময় এখানেই ছিল তৎকালীন বাদশাহদের রাজপ্রাসাদ, দরবার কক্ষ, হল রুম, জামে মসজিদ আর বসবাসের সকল ব্যবস্থাপনা। সেই সময়ই এই প্রাসাদের পাশে কৃত্রিম নদী আর পশুপাখির জন্য উদ্যান তৈরি করা হয়েছিল! মদিনাতুয যাহরাকে বলা যায় ইতিহাসের প্রাসাদ, কারণ এই প্রাসাদ শুধু নির্মাণের ইতিহাস বুকে নিয়েই দাঁড়িয়ে নেই, দাঁড়িয়ে আছে জয়-পরাজয়ের ইতিহাস নিয়েও। আর এই অধ্যায়ে সেসবও স্পর্শ করা হয়েছে প্রচন্ড দক্ষতার সাথে।

Image source: cordobapedia

মালাগায়

মালাগার রাস্তাঘাট পাহাড়ের পাশ দিয়ে নদীর মতো বয়ে চলে। এমন নিরিবিলি, ছিমছাম পরিবেশে নাকি প্রায় সবাই যাত্রাপথে বিরতি দেয়, একটু প্রাণভরে মালাগা দেখার বিরতি। এই শহর প্রায় হাজার বছর আগে থেকেই ছিমছাম, গোছানো এবং সমৃদ্ধ। একসময় মালাগায় উৎপন্ন আঙুরের কদর ছিল সারা স্পেন জুড়ে। সেসময় আরও একটি কারণে মালগা ছিল বিখ্যাত- কারুকার্যময় মৃৎশিল্প। এই শহর মুসলিম শাসনামলের অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রায় আটশ বছর। তখন থেকে আজ অবধি মালাগা দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচু করে।

Image source: procruises.com

এন্তাকীরা

এন্তাকীরা হলো স্পেনের জনপ্রিয় এক চিত্তবিনোদনের শহর। এখানে আছে অসংখ্য গগনচুম্বী হোটেল ও  রেস্তোরা। সমুদ্র উপকূল উপভোগের জন্য এই জায়গাটি পুরো স্পেনজুড়ে প্রশংসিত। বলা হয়ে থাকে, এন্তাকীরার সমুদ্রের ঢেউ মানুষের ভেতরের মানুষকে জাগিয়ে তোলে! মেরিন ড্রাইভ ধরে এগিয়ে গেলে মনে হয় যেন সমুদ্রও পিছু পিছু এগিয়ে আসছে। এখানে এখনও আছে মুসলিম শাসনামলের দুর্গ, শহর প্রাচীরসহ বেশ কিছু স্থাপনা।

 

পরিশেষ

এভাবেই এই বইটি স্পেনের ইতিহাসের সাথে বর্তমান স্পেনকেও পাঠকের সামনে তুলে ধরবে। পাঠক হিসেবে এই ভ্রমণযাত্রা নিঃসন্দেহে উপভোগ্য। এটি আসলেই এক অন্যরকম পাওয়া যে পাঠক একইসাথে শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়াবেন আর সাথে ইতিহাসও জানতে থাকবেন!

 

অনলাইনে বইটি কিনতে ক্লিক করতে পারেন এই লিঙ্কে:

১) স্পেনের কান্না